৭ ই মার্চের ভাষণ এক চিরন্তন আবেদন

৭ ই মার্চের ভাষণ এক চিরন্তন আবেদন

সামছুল আলম দুদু এমপি

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা বিশ্ব ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছে। শোষিত ও নিপীড়িত বাঙালি জাতির মুক্তির পথ নির্দেশিত হয়েছিল সে ভাষণে। মাত্র ১৮ মিনিটের কাব্যিক ভাষণ গোটা জাতিকে প্রেরণা জুগিয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার। বাঙালি মননে চিরন্তন আবেদন সৃষ্টিকারী ভাষণটি আজও ঝংকার দিয়ে ওঠে হূদয়ে। মার্চ মাস, অগ্নিঝরা মাস। এ মাস আমাদের জাগতিক জীবনকে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। বাঙালি জাতি বিশ্বদরবারে বীরের জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল মার্চ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে। সাহসী বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল শত্রুর বিরুদ্ধে। ৭ মার্চের ভাষণের পূর্বাপর বেশ কিছু রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছিল। সে সব ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে চূড়ান্ত জনযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়ে যায় বঙ্গভূমিতে। ভাষণেই স্পষ্ট হয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধ অনিবার্য। বাঙালিকে প্রস্তুতি গ্রহণের উদার আহ্বান জানান ভাষণের মাধ্যমে। সমগ্র জাতি এক মোহনায় লীন হয়ে যায় ঐতিহাসিক ভাষণে। বঙ্গবন্ধুকে কেন ৭ মার্চ এমন ঐতিহাসিক বজ্রধ্বনিতে ভাষণ দিতে হয়েছিল? এ প্রশ্নের জবাবে বহু কথা লিখতে হয়। কিন্তু এত স্বল্প পরিসরে তা বিশ্লেষণ করা খুবই দুষ্কর। ভাষণটির তাত্পর্য এতটাই বিস্ময়কর যে, সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করেও স্বাধীনতার আবেদনটি পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি বুঝে যায় তাদের কী করতে হবে। অত্যন্ত সহজ সরল সাদামাটা অথচ প্রতিটি শব্দের ওজন ছিল অনেক। ভাষণের পরতে পরতে বাঙালির অধিকার প্রতিভাত হয়ে ওঠে। যে জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষিত হয়ে আসছে, সে জাতিকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়, তার এক চমত্কার অটোবায়োগ্রাফি ভাষণে তুলে ধরা হয়েছিল। অধিকারবঞ্চিত আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘকালের। ব্রিটিশ তাড়িয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালে। দ্বি-জাতির থিওরিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলেও তদানীন্তন পাকিস্তানের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির অধিকার নিয়ে লুকোচুরি করা হয়, ছিনিমিনি খেলা হয়। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ছিল গোটা পাকিস্তানের অর্থনীতির ভিত্তি। চা, পাটজাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি হতো। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ পাকিস্তানে চালান করে দেওয়া হতো। কাগজের উত্পাদন এখানে হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে বেশি দামে ক্রয় করতে হতো বাঙালিদের। নানাভাবে বঞ্চিত করা হতো আমাদেরকে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে বাঙালি জাতির দরজা ছিল একরকম বন্ধ। অর্থনৈতিক সীমাহীন বৈষম্য ছিল বাঙালি-অবাঙালিতে। বঙ্গবন্ধু এসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন। পাকিস্তানিদের অত্যাচার নির্যাতন তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তিনি সাংগঠনিকভাবে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। সীমাহীন কষ্ট করেছেন, কিন্তু নতি স্বীকার করেননি। বঙ্গবন্ধু প্রলোভনে প্রলুব্ধ হননি। তিনি নীতিতে অটল ছিলেন। মূলত ভারতবর্ষে বাঙালি জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষিত হয়ে আসছিল। ইংরেজ শাসন অবসানের পর মনে করা হয়েছিল, বাঙালিরা সুশাসনের ভিত্তিতে গণতন্ত্র পাবে। কিন্তু তা পায়নি, উপরন্তু পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতির ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে এক নজির স্থাপন করেছিল। ওরা আমাদের বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করেছিল। এর জন্যে ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে ওঠে। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালে গণতন্ত্র দেওয়ার অঙ্গীকারে সাধারণ পরিষদের নির্বাচন দেয়। সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সংগঠিত হয়। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর হাতেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা ন্যস্ত করার কথা থাকলেও পাকিস্তানি জান্তা শাসক ক্ষমতা না ছেড়ে বাঙালির ওপর অত্যাচার শুরু করে দেয়। সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানিরা সহজে ক্ষমতা ছাড়বে না। তাই তিনি গোটা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলন একসময় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু কিংবদন্তি নায়কে রূপান্তরিত হন। রাজনৈতিক নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। স্বাধীনতাযুদ্ধের কাঠামো নির্মিত ছিল সে ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ মূলত তিনি পাকিস্তানিদের আক্রমণ প্রতিহত করতেই এরকম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতাদিবস হলেও ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। এ যেন এক অগ্নিঝরা ভাষণ। তার ভাষণ ঐতিহাসিক দলিলে রূপান্তর হয়ে আছে। এই ভাষণ আমাদের স্বাধীনতার চিরন্তন আবেদন অক্ষুণ্ন রেখেছে। এটা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের মর্যাদা পেয়েছে। এ ভাষণ আমাদের গর্বের সম্পদ। ভাষণটি জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করেছে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে। ৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীনতা সার্থকতা লাভ করে ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ এখন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।

লেখক :রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *