শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে বিপন্ন মানবজীবন

শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে বিপন্ন মানবজীবন

লেখক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।
মানব জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠ হিসেবে দাবী করার প্রবণতাটি মানব জাতির মধ্যে, সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রকট। কেবল জাতিগত ভাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করলে অন্তত বুঝতে পারতাম, নাহ, যাক মানব জাতির মধ্যে মানবতা বোধ প্রকট। কিন্তু বাস্তবতা তার উলটো, মানব জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নেই বিভেদ খানা সবচেয়ে বেশী। পৃথিবী নামক গ্রহে বাস এবং সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আমাদের সৌরমন্ডল নিয়ে যে গ্যালাক্সিতে আমরা অবস্থান করছি তার নাম ‘মিল্কিওয়ে’। মিল্কিওয়ের মধ্যে এই পৃথিবীতে প্রায় ১৯৫টি স্বাধীন এবং ৫-১০টি পরাধীন, অর্ধপরাধীন রাষ্ট্র এবং এতে ৬০০কোটিরও বেশি লোকসংখ্যার বসবাস।

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এখন মানুষের সামনে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে একমাত্র বাধা স্বয়ং মানুষ। পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভবের পর থেকেই মানুষ নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য সংগ্রাম করছে। সভ্য এর সঙ্গে ‘তা’ প্রত্যয় যোগে যে সভ্যতার দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সেখানে মানব সত্তার, বিবেক সত্তার জায়গা কতটুকু আছে তা বোধগম্য নয়। মানুষ ও পশুর চরিত্র আলাদা করা যাচ্ছে না! যেমন, একটি ষাড়ের স্বভাবই হলো মানুষকে শিং দিয়ে গুঁতো মারা। কিন্তু একজন মানুষ যদি অন্য একজন মানুষকে ধাক্কা দিয়ে কিংবা ঠকিয়ে নিজের বাহাদুরি দেখায় তখন তার আর পশুর মধ্যে কতটুকু পার্থক্য থাকে? স্রষ্টার সৃষ্টি এই শ্রেষ্ঠত্ব মানব তার প্রকৃত কর্মের উর্ধে এসে শোষণ,শাসন কিংবা ভোগ বিলাসের মাধ্যমে সমাজে নিজকে উচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজকে সর্বদা অপব্যবহার করছে।নিজের বুদ্ধিমত্তকে শ্রেষ্ঠ মনে করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কারার চেষ্ঠায় থাকে।

সভ্যতার নামে মানুষ জনপদ, সমাজ, গ্রাম, শহর, বন্দর গড়েছে। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের নামে একের পর এক তা ধ্বংসও করে দিয়েছে। আবার গড়েছে… আবার ধ্বংস করেছে, আবার গড়েছে। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের নামে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ করেছে, পারমানবিক বোমা ফাটিয়েছে… তবু তাদের মনের খেদ মিঠেনি, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ইচ্ছে বিন্দুমাত্র কমেনি। নিজের বিশ্বাস, নিজের তন্ত্র, নিজের ভাষা, নিজের আচার, রীতি, নীতি… শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য সবই চাপিয়ে দিচ্ছে দুর্বলদের উপর।

তাছাড়াও ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রত্যেকটি এলাকার মানুষই মনে করে তারাই উত্তম! পাড়া-মহল্লা-এলাকায় আমাদের প্রতিবেশী আছে, আমরা প্রত্যেকেই মনে করি প্রতিবেশী থেকে আমরা উত্তম! প্রত্যেকটি বাড়ীতেই একাধিক সদস্য আছেন, প্রত্যেকটি সদস্যই মনে করে অন্যদের থেকে আমি বেশি বুঝি, আমি পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে উত্তম!

শ্রেষ্ঠত্বের জন্য অহংকারী ব্যক্তি মানুষের নিকট অপছন্দীয় এমনকি আল্লাহতায়ালার নিকটও সে অপছন্দনীয়। আসলে যারা দিবালোকের মত স্পষ্ট সত্যকে অস্বীকার করে তারা সবচেয়ে বড় অত্যাচারী। এইসব জালিমের কারণে অনেক সাধারণ মানুষ সঠিক ও মুক্তির পথ খুঁজে পায় না।

সারা পৃথিবী আজ অশান্ত, ন্যায় অন্যায় মানুষ গুলিয়ে ফেলেছে। বিবেক, মনুষ্যত্ব আজ নির্বাসনে। রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে কে কার থেকে শ্রেষ্ঠ সেই লড়াই চলছে। অকারণে মানুষ মরছে, তাদের হত্যা করা হচ্ছে।

মানুষ আজ জানেই না সে কেন এতো অত্যাচারিত হচ্ছে! নারীর সন্মান আজ লুন্ঠিত হচ্ছে, একটা ছোট শিশু কন্যাও রেহাই পাচ্ছে না বিকৃত কর্মকাণ্ড থেকে। ধনী গরিবের ভেদাভেদ আজ চরমে। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা আজ হাস্যরসে পরিণত। জ্ঞানী-গুণীদের জ্ঞান যাচাই করছে মূর্খরা। মানুষ মানুষের কষ্টগুলোকে মজা হিসেবে দেখছে।খাদ্য আজ মানুষের ক্ষুধা নিবারণের চেয়ে মজাদানের বিষয় হয়েছে।

খুন, চুরি, দুর্নীতি আজকে যেন সহজ সাধারণ বিষয়। হ্যাঁ, আমরা সেই নিয়তির চরম সময়ে আজ উপস্থিত। হয় মানুষ আবার মানবিকতা ও ন্যায়ের পথে ঘুরে দাঁড়াবে, নয়তো আবার ধ্বংস হবে। সর্বত্র আজ যে অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, তার পরিণতিতে মানুষ যতই হতাশ হোক আর অত্যাচারী নিজেকে যতই অবিনশ্বর ভাবুক, কিন্তু শেষটা হবে ন্যায় আর সত্যের।

মেঘ যত ঘন হয়, সূর্যের উদয় ততই ঘনিয়ে আসে। শুধু মাঝখানে একটা ঝড় বয়ে যায়। অন্ধকার ফেঁড়ে আলো আসবে। হয়তো আমরা সবাই এমন একটা ভোরের অপেক্ষাতেই রয়েছি, যা আবার এই মানুষের হাত ধরেই আসবে।

অতএব সুন্দর কিছু সৃষ্টি করতে হলে প্রাপ্তির আশা না করে শুধু সৃষ্টির নেশায় মগ্ন থাকাই শ্রেয়। মানুষ তাঁর কর্মের জন্য শব্দের তর্জমায় বিভক্ত বলেই তারা তাদের মনুষত্যবোধের বোধিসত্ত্বায় আবর্তিত বোধিধর্মকে ভুলে যায়।

যাঁর ফলপ্রসূতঃ আমরা এই আজকের পৃথিবীতে নিসংশয় নৃশংসতা বর্বরতা সাদাকালোয় ভেদাভেদ ধনি গরীবের ভেদাভেদ জাতপাতের ভেদাভেদ। যা কিছু ভেদাভেদ তাঁর সবই জাহির করে শ্রেষ্ঠত্ব। এই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই যেদিন থেকে মানুষের ভিতরে আর থাকবেনা সেদিন থেকেই মানুষ মানুষকে মানুষ বলেই অনুসন্ধান করবে। সেদিন থেকেই আর কোনো দেশ থাকবে না। জাতি ও বর্ণের পার্থক্য থাকবে না।

মানুষ মানুষের জন্য এই সত্যিটাইই পৃথিবীর বুকে ফলাতে পারেন নতুন এক আলোর দিগন্ত। মানুষের আকৃষ্ট করার মত বা কল্যাণকর কিছু যদি কর্মের মধ্যদিয়ে সৃষ্টি হয়েই যায় তাহলে শ্রেষ্ঠত্বই আপনা আপনি স্রষ্টার পিছে ধাবিত হবে।ধরা দেবে আজ অথবা হাজার বছর পরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *